আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে রাজধানীকে বিএনপির গণসমাবেশ। নয়াপল্টনে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ হবে এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই গণসমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ সদর দফতর থেকে সারাদেশে ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালাতে সব পুলিশ ইউনিটের প্রধান ও সব জেলার পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও পুলিশ বলছে, বিজয় দিবস, বড়দিন ও থার্টিফাস্ট নাইটকে কেন্দ্র করে এ অভিযান চলবে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিএনপিকে দমন করতেই পুলিশের এ অভিযানের নির্দেশনা। বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর শাখার এআইজি মানজুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য যে ধরনের কার্যক্রম থাকা প্রয়োজন সে অনুযায়ী পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কোনও নাশকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে অভিযানের প্রথম দিনে সিরাজগঞ্জ সদর থেকে স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ইসাহাক আলীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে বিএনপির ৯১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মুন্সীগঞ্জে বিএনপির ৩৪০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চারটি মামলাসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। অভিযান চলছে তাদের বাসা এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। গতকাল থেকে মাঠে নেমেছে র্যাবও।
হঠাৎ করে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) আকস্মিক পরিদর্শনে যান কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রি. জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক। এ সময় তিনি দেড় ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে খালি পরে থাকা নারী কারাগারটি দ্রুত ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে বন্দিদের রাখার উপযোগী করার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। এ প্রসঙ্গে জেলার মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, নারী কারাগারটি গত ২ বছর আগে উদ্বোধন হলেও বন্দিদের রাখার নির্দেশনা ছিল না। দ্রুত সেটাকে পরিষ্কার করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন আইজি প্রিজন স্যার। নির্দেশনা অনুযায়ী ধোয়া মোছার কাজ চলছে। সেখানে ৩০০ নারী বন্দিকে রাখার ব্যবস্থা আছে। একটি ডে-কেয়ার সেন্টার, সাধারণ বন্দিদের ৬ তলা একটি ভবন ও সেল রয়েছে কারাগারটিতে।
আইজি প্রিজনের আকস্মিক এভাবে কারাগার পরিদর্শনে অনেকেই বলেছেন, সব কিছুই মিলে সহজেই ধারণা করা যায়, বিএনপির সমাবেশ ঘিরে কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়বে। যেখানে বাড়বে রাজনৈতিক মামলার সংখ্যাও।
পুলিশের অভিযানে বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে নানা শঙ্কায় আছেন নগরবাসী। এ গণসমাবেশকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এরইমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ২ দিনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের চিত্র তুলে ধরা হয়। দলের সিনিয়ার যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়ীখাল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. শহীদুল ইসলাম কাড়াল, উপজেলা ছাত্রদল সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম বাদশা, তন্তর ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল হাসান শাহাবুদ্দিন, শ্রীনগর ইউনিয়ন যুবদল নেতা বাবুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি ও হামলা চালিয়েছে। স্থানীয় বিএনপির সদস্য সচিবসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক শেখ মো. আব্দুল্লাহকে প্রধান আসামি করে ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় মধ্যপাড়া ইউনিয়ন বিএনপি আহ্বায়ক আজিম আল রাজী ও বালুচর ইউনিয়ন বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফারুক হোসেন, রসুনীয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হাসান দেওয়ান, রাবদী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মো. রফিকুল ইসলাম, জামপুর ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মো. ফারুক, মো. বাদল, মোগড়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মো. জামাল হোসেন ও যুবদল নেতা মো. আরিফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া যুবদল নেতা আল আমিন ও বিএনপি নেতা লাল মিয়া মুন্সিগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে গেলে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করেছে বলে অভিযোগ করেন রিজভী।
বিএনপির এই নেতা জানান, ময়মনসিংহ মহানগর ৪ নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল পাঠানসহ ৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলা বিএনপি নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মামুন, হেলাল খানসহ ১০ জনকে গ্রেফতার ও ৩৫ জনের নামে বানোয়াট মামলা দেয়া হয়েছে। সদর উপজেলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৮ জনকে। জেলা যুবদল সভাপতি জীবন দাশসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান গাজীপুর মহানগর ছাত্রদল সাবেক সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলমকে দুপুরে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কাউলতিয়া থানা যুবদলের আহ্বায়ক নাজমুল সরকার, কাশিমপুর থানা যুবদলের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম শাহীন ও সদস্য সচিব কেএম হাফিজুর রহমান রাজো, কোনাবাড়ি থানা যুবদলের সদস্য সচিব আজিজুল ইসলামকে বিনা ওয়ারেন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করেছে। তিনি জানান, গাজীপুর সদর থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আজহার মেম্বার, দুলাল মোল্লা, জাকির, মোখলেছ ব্যাপারীসহ কমপক্ষে ২৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রিজভীর অভিযোগ ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলায় গত বৃহস্পতিবার জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের সহোদর মোশাররফ হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত না হওয়া সত্ত্বেও শহিদুল ইসলাম বাবুলের ভাই এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পারিবারিকভাবে ফোর্টিন জেনারেশনে তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। এটি কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসাÑ তা বোধগম্য নয়। এই ঘটনা ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম এর বাসার কেয়ারটেকার নুর আলমসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিউমার্কেট থানা ১৮ নং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা লোকমান হোসেন মো. বাবুল, মো. বাবু, কলাবাগান থানা শ্রমিক দল নেতা রাসেল হাওলাদার, ছাত্রদল নেতা মো. ইয়াসিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক দলের সদস্য আবুল কাউসার, কলাবাগান থানাধীন ১৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির আহবায়ক মো. মিন্টুকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব।
এছাড়া কলাবাগান থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইয়াসিন, ধানমন্ডি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো পলাশকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রুহুল কবির রিজভী। তিনি জানান কাফরুল থানা বিএনপি শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ও জিসাস কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন হেলালকে ৩০ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়েছে, ঢাকা জেলা জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু সেলিম চৌধুরীকে ২৪ নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নারায়ণঞ্জের ফতুল্লা থানা কুতুবপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলামসহ গত দুই দিনে ঢাকা এবং আশাপাশের জেলা থেকে কমপক্ষে ৫৩৬ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রিজভী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল, যাদের একমাত্র সাধনা অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখা। ক্ষমতা লাভের আগে বা পরে কোনো সময় তারা ন্যায়নীতি গ্রাহ্য করেনি। এ কারণেই গণতন্ত্রের নাম শুনলেই তারা চমকে ওঠে। যেন তেন প্রকারে ক্ষমতায় এসেই আঁটঘাট বেঁধে গণতন্ত্র, গণঅধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন করতে উঠেপড়ে লাগে।
সূত্র জানায়, এবার পুলিশের দাবি আগের মতো আর বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে গায়েবি মামলা দেবে না। এবার গায়েবি মামলা না দিয়ে পুরোনো মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির তালিকায় সক্রিয় নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছর রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৩১টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ২৩টি মামলার বাদী পুলিশ। এরমধ্যে শাহবাগ থানায় ৬টি, ধানমন্ডি থানায় একটি, হাজারীবাগ থানায় একটি, কোতোয়ালি থানায় দুটি, বংশাল থানায় একটি, তেজগাঁও থানায় একটি, পল্টন থানায় দুটি, মতিঝিল থানায় একটি, রামপুরা থানায় একটি, যাত্রাবাড়ী থানায় দুটি, শ্যামপুর থানায় একটি, বাড্ডা তিনটি, বনানী থানায় দুটি, পল্লবী থানায় দুটি, কাফরুল থানায় একটি, দারুল সালাম থানায় একটি, উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি এবং তুরাগ থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।